একটা খুব মজার গল্প প্রচলিত আছে। এক রাজার খুব ঘন ঘন মুড.....

masjid-al-haram


একটা খুব মজার গল্প প্রচলিত আছে। এক রাজার খুব ঘন ঘন মুড সুইং হয়। মানে, এই ভালো তো এই খারাপ। এই খারাপ তো এই ভালো! এই সমস্যার প্রতিকার-কল্পে তিনি নানান সমাধান খুঁজে বেড়াচ্ছেন কীভাবে তার এই অবস্থার পরিবর্তন করা যায়।
রাজ্যের একজন জ্ঞানীলোক রাজার জন্য সমাধান তৈরি করে আনলেন। একটা পাথরে তিনি এমন এক মূল্যবান বাণী খোদাই করে নিয়ে আসলেন যা রাজার এই সমস্যাকে সমূলে দূরীভূত করতে সক্ষম।
তিনি রাজাকে বললেন, ‘মহারাজ, আশা করছি এতেই আপনি আশানুরূপ প্রতিকার পাবেন। এতে এমন এক বাণী খোদাই করা আছে যা আপনার সমস্ত মন খারাপের দিনে আপনাকে আনন্দের সংবাদ এনে দিবে এবং যখন আপনি আনন্দের আতিশয্যে বাস্তবতাকে বেমালুম ভুলে যেতে বসবেন, এই বাণী আপনাকে তখন টেনে বাস্তবতায় নিয়ে আসবে’।
রাজা তো বটেই, রাজসভার উজির-নাজির সকলেই বিস্ময়ে হতবাক! কী এমন লেখা আছে ওই পাথরে যা রাজার সকল সমস্যাকে এতো সহজে দূরীভূত করে দিতে পারে? যে সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুঁজতে রাজ্যের পাইক-পেয়াদা থেকে শুরু করে উজির-নাজির সকলে ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত, এই লোক সেই সমস্যার সমাধান হিশেবে কী এমন পরশ-পাথর নিয়ে আসলো?

সেটা এক পরশ পাথর-ই বটে! তাতে যে কথাটা খোদাই করা ছিলো তা হলো— ‘এ-সময় শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে’।
কিন্তু রাজা বুঝতে পারলেন না এই কথাটা কীভাবে তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে। সেই জ্ঞানী লোকটাকে রাজা বললেন, ‘তোমার কথা না-হয় বুঝলাম, কিন্তু পাথরে খোদাই করা এই বাণী কীভাবে আমার উপকারে আসবে তা তো বললে না’।
লোকটা বললো, ‘মহারাজ, আপনি শুধু পাথরটাকে নিজের সাথে রাখবেন। যখন আপনার মানসিক বৈকল্য কিংবা আনন্দের আতিশয্যের পালা আরম্ভ হবে, তখন পাথরটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিলেই হবে। বাকিটা আপনি তখনই বুঝতে পারবেন’।
এর কিছুকাল পরে পার্শ্ববর্তী অন্য আরেক রাজার আক্রমণে বিধ্বস্ত হতে লাগলো পূর্বেকার সেই রাজা। অবস্থা এমন যে— রাজ্য হারানোটা কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার! যুদ্ধে রাজাও ভীষণভাবে আহত। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও শরীরে মজুদ নেই। এমন সময় রাজার মনে পড়লো সেই পাথরটার কথা। ওই লোকের কথামতো রাজা সেটা সারাক্ষণ নিজের সাথে রাখছিলেন।
পাথরটাকে চোখের সামনে ধরে ভালোভাবে তাতে দৃষ্টি দিলেন তিনি। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো কথাটা— ‘এ-সময় শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে’।
কথাটা যেন ভেতর থেকে টেনে তুললো রাজাকে। নিজের মনকে রাজা বোঝালেন, ‘তাই-তো! এই পরাজয় তো সাময়িক। এই পরাজয়ের শেষ আছে এবং শেষপ্রান্তে আছে আমার বিজয়ের সম্ভাবনা। এ-সময়, হ্যাঁ এ-সময় শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে’।
ভেঙে পড়া রাজার মনোবলকে এই কথাটা দারুনভাবে উৎফুল্ল করে তুললো। তিনি আহত সৈনিকদের সেবা-যত্ন করে, নতুনভাবে সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধে জড়ালেন এবং বিজয়ী হলেন। পাথরে খোদাই করা সেই কথাটা তার জীবনে দারুনভাবে সত্য হলো। পরাজয়ের সেই সময়টা শীঘ্রই ফুরিয়ে গেলো।
এরপর, বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন রাজা। রাজ্য পুনরুদ্ধারের খুশিতে তিনি গোটা রাজ্যময় উৎসবের আয়োজন করলেন। উৎসব, আনন্দ আর ফুর্তিতে কাটতে লাগলো রাজার দিনগুলো। এরপর একসময় সেই পাথরের কথা রাজার মনে এলো যা একদিন তাকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে বিজয়ের রাস্তা দেখিয়েছিলো। সেই পাথর চোখের সামনে তুলে ধরলেন রাজা। সেই অমূল্য বাণী আবারও জ্বলজ্বল করে উঠলো তার সামনে— ‘এ-সময় শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে’।
কথাটা যেন মুহূর্তেই বাস্তবতায় নামিয়ে আনলো রাজাকে। তিনি ভাবলেন, ‘সত্যিই তো! যেকোন মুহূর্তে আবারও আক্রমণের শিকার হতে পারি। হারাতে পারি রাজ্য আর রাজত্ব। সিংহাসন ছেড়ে কাল হয়তো বনে বনে ঘুরে বেড়াতে হবে আমাকে। এই বিজয় তো সাময়িক। সম্মুখেই হয়তো ওঁৎ পেতে আছে বড় কোন পরাজয়। পরাজয়ের ছায়া মাথায় নিয়ে এই আনন্দ, এই উৎসব আর ফুর্তির কোন কি মূল্য আছে?’
আনন্দের আতিশয্যে গা ভাসানো রাজার সম্বিৎ ফিরলো। তিনি বুঝতে পারলেন জীবনের পরম এক বাস্তবতা— জীবনের কোন অবস্থাই আদতে চিরস্থায়ী নয়।
(২)
গল্পের মূল বার্তাটার সাথে কেউই সম্ভবত দ্বিমত করবে না। জীবনের কোন অবস্থাই যে চিরস্থায়ী হয় না— সে কথা আমাদের সকলের জানা। আমরা আমাদের জীবন থেকে এবং চারপাশের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু উপলব্ধি করতে পারি যে— আমাদের সব দিন সর্বদা সমান কাটবে না।
যে আছে সুখের চরম শিখরে, তারও আছে দুঃখের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার ভয়। আবার, দুঃখের গহনে যার নিত্য উঠাবসা, হৃদয়ের কোথাও তারও আছে সুখী হওয়ার দারুন স্বপ্ন। রাজারও থাকে রাজ্য হারানোর চিন্তা আর প্রজারও থাকে সম্রাট হয়ে উঠার শখ। দিন আর রাতের মতো জীবনেরও উত্থান-পতন হয়। কেউ ভাঙে, কেউ-বা ফিরে পায় জীবনের কূল।
তবু— জীবনের এই পরম বাস্তবতা উপলব্ধি করেও আমাদের আয়োজনের কোথাও কোন ব্যত্যয় ঘটে না। আমরা জীবন সাজাই, আবার সাজানো জীবন তছনছ হলে দুঃখে কাতর হয়ে পড়ি। জীবনের ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগাই। সেগুলো আবার ভাঙে, আবার আমরা পসরা সাজাই। এমন এক অনিবার্য জীবনের চক্রে আমরা জড়িয়ে থাকি যার যবনিকা পতন ঘটে আমাদের মৃত্যুর দিন।
যেদিন আমরা জীবনের পাঠ চুকিয়ে পাড়ি জমাই অনন্ত জগতে, সেদিন আমাদের সাজানো সংসার, সাজানো আয়োজন থেমে যায়। অথবা— সেই সংসার, সেই আয়োজন থেকে আমিই বরং বাদ পড়ে যাই। আমার শূন্যস্থান দখল করে অন্য কেউ। আমার জীবনচক্রে তখন জড়িয়ে পড়ে অন্য কারো জীবন।
এই সুখ কিংবা এই দুঃখ— দুটোর কোনোটাই আমাদের জীবনে চিরস্থায়ী নয় জেনেও আমাদের সমস্ত মনোযোগ যেন এই জীবনকে ঘিরেই আবর্তিত। কিন্তু, যদি এমন হতো, আমরা যদি এমন এক জীবনের সন্ধান পাই যেখানে কোন দুঃখ নেই, কোন মন খারাপ নেই, নেই কোন হৃদয় ভাঙার গোঙানি, তাহলে কেমন হতো?
কেমন হতো যদি সেখানে পাওয়া যেতো কেবল অনাবিল আনন্দ, অবিরাম-অবিরত সুখ আর নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তির হাতছানি? যদি সেখানে কোন দুঃখের ছোঁয়া না থাকে, যদি সেখানে না থাকে কোন অশান্তি-অনিয়মের রেশ, কেমন হবে সেই স্বপ্নরাজ্য? সেই রাজ্যের দেখা পেতে মানুষ কি মরিয়া হয়ে যাবে না? তার মন কি উতলা হবে না সেই জীবনের সন্ধান পেতে? যে পরম সুখের দেখা পেতে মানুষ জীবনভর সংগ্রাম করে, যদি তার সেই স্বপ্নের জীবনের সন্ধান কেউ তার সামনে মেলে ধরে, যদি তাকে বাতলিয়ে দেয় সেখানে যাওয়ার পথ, সে কি আনন্দের আতিশয্যে আত্মহারা হবে না?
সেটা এক স্বপ্নরাজ্যই বটে! আর সেই রাজ্যের সন্ধান আপনাকে আপনার রব ছাড়া দুনিয়ার আর কে দিতে পারে?
দেখুন, জীবনের এই উত্থান-পতন জেনেও দুনিয়াকে ঘিরে আপনার কতো কী আয়োজন! আপনার এই বাহারি আয়োজনের সবকিছু একদিন ফুরিয়ে যাবে অথবা সেগুলোকে ছেড়ে যেতে হবে জেনেও আপনার ভবোদয় ঘটে না। চারপাশের সবকিছু নিশ্চিতরূপে ভঙ্গুর জেনেও আপনি এমনভাবে বাঁচেন যেন এসব আপনাকে কোনোদিন ছাড়বে না অথবা আপনি ছেড়ে যাবেন না এসবের কোনোকিছু। যে সাময়িক জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়ে আপনার এতোখানি আয়োজন, অনন্ত সেই সুখ রাজ্যের ব্যাপারে তাহলে আপনার কতোখানি আয়োজন থাকা দরকার?
এই জীবনে যিনি সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তার জন্যে আছে এক মহা-সুংবাদ। সু-সংবাদ তার জন্যেও যিনি ছাড়তে চান না আয়েশী জীবন। দুঃখের ভারে নুইয়ে পড়েছে যার জীবন, জীবনের ক্লান্তি আর অবসাদে যে বিপন্ন-প্রায়, তাকেও জানাতে চাই এক মহা-সংবাদ! আপনার রব জানাচ্ছেন—
‘তোমার জন্য অবশ্যই আছে অফুরন্ত পুরস্কার’ [১]
আপনার রব আপনাকে সেই জীবনের দিকে ডাকছেন যেখানে আপনার জন্য রাখা আছে অফুরন্ত নিয়ামত! অফুরন্ত সুখ! অফুরন্ত প্রশান্তি!
সেখানে আপনাকে মাসের বেতন নিয়ে টানাহেচড়ায় পড়তে হবে না। চাকরির জন্যে হাপিত্যেশ করা লাগবে না। সন্তানের ক্যারিয়ার নিয়ে দূর্ভাবনায় থাকতে হবে না। সেখানে বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতার ভয় নেই, ক্ষমতাবানের রুক্তচক্ষু নেই, নেই সমাজের মাতব্বর-মুরুব্বির কড়া আর কটু কথা শোনার বিড়ম্ভবনা। সেই জীবনে সমস্ত ক্লেদ-ক্লান্তি আর বিষাদের জ্বালা থেকে আপনি মুক্ত। সমস্ত জড়তা-জীর্ণতা আর জিঘাংসার ছোবল হতে আপনি সেখানে নিরাপদ। আপনার জন্যে সেখানে বন্দোবস্ত করা আছে এমন এক জীবন যা আপনার অবচেতন মন সর্বদা কামনা করে।
ভাবুন তো— কেউ কোন এক চাকরি-প্রার্থীকে এসে বললো, ‘অমুক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে আপনি পেয়ে যাবেন আপনার কাঙ্খিত চাকরি। আর, সেই চাকরি কোনোদিন চলে যাওয়ার ভয় নেই’। এমন আশ্বাস যদি কোন চাকরি-প্রার্থী পায় যার চাকরিটা খুব করে দরকার, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য চাকরি-প্রার্থীর চেষ্টা তখন কেমন হবে?
সংসারে শান্তি নেই এমন কাউকে কেউ যদি বলে, ‘এই কাজটা করুন, তাহলে আপনার সংসারে শান্তি ফিরে আসবে এবং তা আর কোনোদিন মিলিয়ে যাবে না’। এমন আশ্বাসে সংসারে অতিষ্ট হয়ে উঠা সেই মানুষটা কতোখানি আপ্লুত হবে আর সেই অফুরন্ত শান্তি লাভে কেমন মরিয়া হয়ে উঠবে বলুন?
যার শরীরে মরণ-রোগের বাসা, তাকে যদি কেউ বলে, ‘প্রতিদিন তিন মাইল যদি হাঁটতে পারেন, আপনার শরীর থেকে সমূলে দূর হবে রোগ। আর কোনোদিন আপনি ওই রোগে আক্রান্ত হবেন না’। এমন ভরসা পেলে ভগ্ন শরীর নিয়েও ওই ব্যক্তি কি তিন মাইল হাঁটবে না?
তাহলে যেখানে চাকরি-প্রাপ্তির কোন চিন্তা নেই, যেখানে সংসারের অশান্তির কোন কষ্ট নেই, যেখানে নেই কোন রোগ-শোকের প্রশ্ন— এমন এক স্বপ্নময় জীবনের প্রতিশ্রুতি যখন আপনার রব আপনাকে দেয়, সেই জীবনের জন্য আপনার কেমন তাড়াহুড়ো থাকা উচিত? কেমন তৎপরতা আপনার দরকার সেই জীবনকে ঘিরে?
গল্পের সেই রাজার মতো, সেই স্বপ্নরাজ্যের কোন লোক এসে আপনাকে বলবে না, ‘এ-সময় শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে’। কারণ আপনার সেই সুখ, সেই শান্তি তো কখনোই ফুরোবার নয়। এ-যে আপনার রবের ওয়াদা।
‘তাদের জন্য আছে অফুরন্ত প্রতিদান’। [২]
সেই অফুরন্ত নিয়ামত পাওয়ার জন্যে, সেই অনন্ত অনাবিল সুখের সাগরে অবগাহনের জন্যে হবে কি আপনার একটু সময়? একটু সময় আপনার রবের জন্য?
রেফারেন্স:
১. সুরা আল-ক্বালাম, আয়াত-০৩
২. সুরা আত-ত্বীন, আয়াত-০৬
'কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ-০৭'

Post a Comment

0 Comments