রেজা করিম ও তানিম আহমেদ, ঢাকা
ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপিসহ সরকার-বিরোধীদের অবস্থান কর্মসূচি আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথে ‘নতুন মোড়’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। দাবি আদায়ে বিএনপি কতটা মরিয়া, তা বোঝা গেছে সেদিন। বহুদিন পর আবার তারা মাঠে নেমেছিল পুলিশের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও পিছপা হয়নি। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীনেরা এদিন দেখিয়েছে, বিরোধীদের কোনো রকম ছাড় দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। ছাড় তারা দেবেও না।
সংঘাত-নাটকীয়তায় ভরা ওই কর্মসূচি ঘিরেই এখন যত আলোচনা। সেদিনের নাটকীয়তা ও সংঘাতই এখন দুই পক্ষের কথার যুদ্ধের হাতিয়ার। শুধু তা-ই নয়, আগামী দিনের কর্মকৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওই কর্মসূচিতে নিজেদের ভুলত্রুটিকেও আমলে নিচ্ছে তারা।
এদিকে দুই পক্ষের জোর লড়াইয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তারপরও তাঁরা সংঘাতের পথে না গিয়ে সংলাপের জন্য সব পক্ষকে; বিশেষ করে সরকারকে নমনীয় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ গতকাল রোববার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীনেরা একটু নমনীয় হয়ে দুই পক্ষের সম্পাদক পর্যায়ে একটা আলোচনার ব্যবস্থা করতে পারে। এতে তাদের পরাজয় হবে না। উল্টো এটা করলে রাজনৈতিকভাবে তারাই এগিয়ে যাবে।’
বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে তাদের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের এক দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার সারা দেশে মহানগর ও জেলা পর্যায়ে জনসমাবেশ করবে তারা।
এর আগে সর্বশেষ গত শনিবার এক দফার কর্মসূচি হিসেবে ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি ও সমমনারা।পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বেলা ১১টায় কর্মসূচি শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন নেতা-কর্মীরা। দফায় দফায় চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। ইটপাটকেল নিক্ষেপের বিপরীতে পুলিশ ছোড়ে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট। পাশাপাশি লাঠি, জলকামানও ব্যবহার করে পুলিশ।
দিনভর চলা সংঘর্ষে নগরীর বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর করাসহ বাসে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। সংঘর্ষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলটির অনেক নেতা-কর্মী আহত হন। এদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, হয়েছে মামলাও। সংঘর্ষের জন্য দুই পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করছে।
গতকাল এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তারা (বিএনপি) ২০১৩-১৪ সালেও চলন্ত বাস, ট্রেন ও লঞ্চে আগুন দিয়ে মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। দেশের মানুষ গতকাল (শনিবার) তাদের ভয়ংকর চেহারা দেখেছে। কারণ, তারা আবারও আগুন-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়েছে।’
যদিও এই কাজ বিএনপি করেনি দাবি করে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘পুলিশের সাহায্যে সরকারি লোকেরা, এজেন্সির লোকেরা, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা এসব ঘটনা ঘটিয়ে, ভিডিও করে পুলিশের সামনেই মোটরসাইকেলে করে চলে গেছে।’
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটা পরিষ্কার হয়েছে, তারা (বিএনপি) জ্বালাও-পোড়াও করে দেশে পানি ঘোলা করতে মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে নেমেছে।’ শনিবারের সব অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে বিএনপি বলে দাবি করেন দলটির আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনও।
আওয়ামী লীগের এমন অভিযোগকে ‘অপপ্রচার’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব ব্যবসা এখন আর চলে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগুন-সন্ত্রাস করি না। কাজেই আমরা এর দায়িত্ব নেব না।’
আর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘একতরফা নির্বাচনের জন্য সরকার কতটা হিংস্র হতে পারে, আগুন-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়ে তারা প্রমাণ করেছে। তবে আগুন-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়ে এবার আর কোনো লাভ হবে না। এ বিষয়ে আসল সত্যটা এখন বিশ্ববাসী জেনে গেছে।’
বিএনপিতে লাভ-ক্ষতির হিসাব
এদিকে শনিবার ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েও নানা আলাপ আছে বিএনপিতে। এই কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষে বিএনপির লাভ হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির অনেকে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর পুলিশের অনুমতির তোয়াক্কা না করে রাজপথে অবস্থান নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
মাতুয়াইলসহ কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সঙ্গে অনেকক্ষণ মুখোমুখি অবস্থান বজায় রাখতে পেরেছিলেন তাঁরা। আর বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের রাস্তায় পেটানোর দৃশ্য সারা বিশ্বের কাছে চলে গেছে। এটাও বিএনপির আন্দোলনের পক্ষে গেছে বলে দলটির নেতারা মনে করছেন।
যদিও এর বিপক্ষে ভিন্নমতও আছে অনেকের। তাঁরা বলছেন, শনিবারের কর্মসূচি থেকে বিএনপির লাভ যতখানি হয়েছে, তার চেয়ে চাপে পড়েছে বেশি। শনিবারের কর্মসূচি গোছানো ছিল না বলেও অভিযোগ তাঁদের।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে এমনটা হয়েছে বলে জানিয়ে নেতারা বলছেন, শুক্রবার ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে রোববার সচিবালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার কথা ছিল বিএনপি ও সমমনাদের।
কিন্তু মহাসমাবেশ চলাকালেই হঠাৎ সেই সিদ্ধান্ত বদলে যায়। এতে রোববারের কর্মসূচি বাতিল করে শনিবার নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকটি নতুন কর্মসূচিতে যোগ দিতে হয়েছে নেতা-কর্মীদের। পরিশ্রান্ত নেতা-কর্মীরা তাই পরের দিনের অবস্থান কর্মসূচিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। আবার অনেক বড় বড় নেতাকে এদিন মাঠে পাওয়া যায়নি।
তারুণ্যের সমাবেশ, মহাসমাবেশ ও ঢাকায় অবস্থানের জন্য ঢাকার বাইরে থেকে যাঁরা এসেছিলেন, জেলা-মহানগরে জনসমাবেশের ঘোষণার পর তাঁরা আবারও ঢাকা ছেড়েছেন। ঢাকায় আসা, ঢাকা ছাড়া—এভাবে করতে গিয়ে নেতা-কর্মীরা অনেকটা ক্লান্ত হচ্ছেন বলেও মনে করছেন অনেকে। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানকে নিয়ে দিনভর চলা বিভিন্ন ঘটনাও সন্দেহ জাগিয়েছে নেতা-কর্মীদের মনে। যদিও এসব বিতর্কে কান না দিয়ে ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে নেতা-কর্মীদের সাহস ও উদ্দীপনা বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এই সরকারকে বিদায় করতে চাই। কিন্তু সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে সহিংস করার চেষ্টা করছে। এ জন্য আমরা খুব হিসাব করে পা ফেলছি। এই অবস্থায় সতর্ক থেকে সজাগ দৃষ্টি রেখে কর্মসূচি ঠিক করছি।’
আ.লীগের কর্মসূচিতে তালগোল
গত শনিবার আওয়ামী লীগ নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। বিএনপি রোববার কর্মসূচি পালন করবে, এটা ধরে নিয়েই এদিন দিনব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় তারা। কিন্তু বিএনপি রোববার কোনো কর্মসূচিই দেয়নি। গত শনিবার রাতে সিদ্ধান্ত হয়—বিএনপির কর্মসূচির দিন সোমবার বিকেলে শান্তি সমাবেশ করবে।
কিন্তু গতকাল সকালে সিদ্ধান্ত হয়, শান্তি সমাবেশের পরিবর্তে তারা থানায় থানায় অবস্থান নেবে। এ রকম ঘটনাকে সমন্বয়হীনতা বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য। তিনি বলেন, বিএনপির কর্মসূচির দিন পাল্টা কর্মসূচি দেওয়ায় এমনিতেই নানান কথা শুনতে হচ্ছে। এর মধ্যে তাদের সঙ্গে একই দিন কর্মসূচি দিয়ে আবার সেটা বাতিল করায় নতুন সমালোচনা সৃষ্টি হতে পারে। এই সময়ে আমাদের আরও বেশি সমন্বিত কাজ করা উচিত।
0 Comments